সূর্যের রং ঢং।
প্রতিদিন পৃথিবীর আকাশে একটা আগুনের গোলা পুব থেকে পশ্চিমে চলে যায়। এ আমাদের অতিচেনা দৃশ্য। এ অগ্নিগোলাটাই আমাদের চেনা নক্ষত্র, আমাদের সৌরজগতের অধিপতি—সূর্য। সেই প্রাগৈতিকহাসিক কাল থেকে, এমনকি পৃথিবীতে দুপেয়ে মানবজাতি আসার আগে থেকেই ঘটে চলছে এই একঘেয়ে ঘটনা। প্রাচীন মানুষদের কাছে এ দৃশ্যটা ছিল অতি উদ্ভট আর চমকপ্রদ। তাই তারা সেই অগ্নিগোলক বা সূর্যকে দেবতা ভাবতে শুরু করেছিল। সেই রহস্যময়, শক্তিশালী দেবতার জন্য পূজা-অর্চনারও কমতি ছিল না। এর রেশ এখনো রয়ে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন জাতিতে।এখন অবশ্য আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে সূর্যের রহস্যের জট অনেকটাই খুলে গেছে। আধুনিক মানুষের কাছে সে দেবতার গরিমা হারিয়েছে অনেক আগেই। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, মহাবিশ্বের কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে সূর্য স্রেফ একটা মাঝারি মানের নক্ষত্র। অবশ্য তাতে পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকার জন্য কিংবা শক্তির উৎস হিসেবে সূর্যের অপরিহার্যতা খাটো করা হয় না। বরং তার রহস্যের জটাজালগুলো খোলার কারণেই পৃথিবীতে সূর্যের ভূমিকাটা সঠিকভাবে বোঝা যায়। এককথায়, পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ, আবহাওয়া, আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য, আবেগ সবকিছুতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব রাখছে এই অগ্নিগোলক।
সূর্য অতি উজ্জ্বল। সারাক্ষণ জ্বলছে গনগন করে। সূর্য থেকে প্রতি মুর্হূতে বেরিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ শক্তি। আর এ শক্তির উৎস, ফিউশন বিক্রিয়া। তাতে তৈরি হচ্ছে বিপুল তাপ, শক্তি ও আলো। সূর্যে উৎপন্ন এসব আলো বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। এর মধ্যে ক্ষতিকর কিছু রশ্মি আটকে যায় পৃথিবীর ওজোন স্তরেই। তবে পরিবেশ দূষণ তথা জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে ওজন স্তর ফুটো হয়ে কিছু ক্ষতিকর রশ্মি নেমে আসে ভূপৃষ্ঠে। এর মধ্যে রয়েছে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি বা অতিবেগুনি রশ্মি। আমাদের ত্বক অতিমাত্রায় এ রশ্মির সংস্পর্শে থাকলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সূর্যালোকে আরও আছে অবলোহিত বা অবলাল রশ্মি। ইংরেজিতে একে বলে ইনফ্রারেড। সূর্যের এই আলোর জন্যই আমরা ত্বকে উষ্ণতা অনুভব করি। শীতের রোদ পোহাতে এ কারণেই মজা। অবশ্য যতই আরাম লাগুক, শীতের রোদে ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেটও থাকে।
বলতে পারবেন, সূর্যের প্রকৃত রং কী?
এর
উত্তরে বেশিরভাগ মানুষই হয়তো ভুল উত্তর দেবেন। কেউ বলবেন, হলুদ। কেউ বলবেন,
লাল। কিন্তু সূর্যের রং হলদে বা লালচে কোনোটাই নয়, বরং সাদা বলা যায়।
অবশ্য সেটাও নির্ভর করে রঙের ব্যাখ্যার ওপর। অর্থাৎ আমাদের চোখ রং কীভাবে
দেখছে তার ওপর।
সূর্যের প্রকৃত রং কী?
সূর্য চরম উত্তপ্ত গ্যাসীয় গোলক। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সূর্যের বর্ণালী মাপলে দেখা যায়, সূর্য বর্ণালীর দৃশ্যমান আলো নিঃসরণ করে। অর্থাৎ আলোর বর্ণালীর যে অংশটুকু আমরা দেখতে পাই সেগুলো। এটা কাকতালীয় ব্যাপার নয়। আসলে মানুষের চোখ এমনভাবে অভিযোজিত হয়েছে যে সূর্য যে আলো সবচেয়ে বেশি নিঃসরণ করে, সেটাই আমরা দেখতে পাই। দৃশ্যমান আলো ছাড়াও সূর্য থেকে অতিবেগুনি, অবলোহিত রশ্মি নিঃসৃত হচ্ছে। অবশ্য তার পরিমাণ দৃশ্যমান আলোর মতো বেশি নয়।
কোনো বস্তুর রং আমরা কী দেখতে পাবো, তা নির্ভর করে আমাদের দেখার পদ্ধতির ওপর। আমাদের চোখের রেটিনায় দুই ধরনের কোষ থাকে। এদের বলা হয় রড কোষ ও কোন কোষ। রাতে বা স্বল্প আলোয় দেখার জন্য রড কোষ কাজ করে। আর উজ্জ্বল আলোয় কাজ করে কোন কোষ। এই কোষগুলো রং শনাক্ত করে। বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর চোখে দুই ধরনের কোন কোষ থাকলেও মানুষের চোখে আছে তিন ধরনের। সেগুলো এল, এম এবং এস নামে পরিচিত। এই কোষগুলো যথাক্রমে দৃশ্যমান আলোর দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা লাল, মাঝারি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা হলুজ ও সবুজ এবং ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা সবুজ রং দেখার জন্য কাজ করে। এল-কোনকে লাল কোন কোষও বলা হয়। কারণ, এরা দীর্ঘ বা লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি সংবেদনশীল (বেশিরভাগ স্তন্যপায়ীর চোখে এটি নেই)। এম-কোনকে বলা হয় সবুজ কোণ, কারণ তা দৃশ্যমান আলোর মাঝারি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি সংবেদনশীল। আর এস-কোনকে বলা হয় নীল কোন, কারণ তা দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি সংবেদনশীল।চোখের রেটিনায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ কোন কোষ আছে, অন্যদিকে রড কোষ আছে প্রায় ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ। আমাদের মস্তিষ্ক এসব কোষ থেকে পাওয়া সংকেত একত্রিত করে হাজারো রঙের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। কথাটা যত সহজে বললাম, পুরো প্রক্রিয়াটা ততটাই জটিল। কোনো আলো কোন কোষগুলোয় আঘাত করলে বিভিন্ন রঙের আলোর তীব্রতা কেমন, সে সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছায়। সেগুলো তুলনা করে, মস্তিষ্ক এদের রং হিসেবে ব্যাখ্যা করে। যেমন যদি এস (বা নীল) ও এম কোন (বা সবুজ) কোষগুলো শক্তিশালীভাবে সক্রিয় হয়, কিন্তু এল (বা লাল)-এর সক্রিয়তা কম থাকে, তাহলে চোখে সবুজাভ রং দেখা যাবে। আবার এস ও এম কোনগুলো কম সক্রিয় হলে এবং এল শক্তিশালী হলে লালচে রং দেখা যাবে। আর দৃশ্যমান বর্ণালী থেকে আসা আলোর সবগুলো যদি সমান উজ্জ্বল হয়, তাহলে আমরা সাদা রং দেখার অনুভূতি পাই। সূর্যের ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই ঘটে। অর্থাৎ লাল, নীল ও সবুজ শক্তিশালীভাবে সক্রিয় হয়। তাই সূর্য দেখায় সাদা।
অবশ্য কথাটা আংশিকভাবে সত্য। উত্তরটা মহাকাশে বা আমাদের বায়ুমণ্ডলের ধুলিকণা ও অন্যান্য পদার্থে আঘাত করার আগে সূর্যের আলোর জন্য সত্য। নভোচারীরা মহাকাশে সূর্যকে সাদা দেখেন। কিন্তু সূর্যের আলো আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বা বাতাসের মধ্যে দিয়ে চলার সময় কিছুটা ঢং করে। মানে রং বদলায়। কারণ এ আলোর কিছুটা বাতাসে শোষিত হয় কিংবা ছড়িয়ে পড়ে। বাতাস বা বায়ুমণ্ডলে সব রং সমানভাবে প্রভাবিত হয় না। যেমন লালের তুলনায় নীল রং বেশি ছড়িয়ে পড়ে বা বিক্ষিপ্ত হয়। তারও কারণ আছে। আসলে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর (যেমন লাল) চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (যেমন নীল) বায়ুমণ্ডলে বেশি ছড়ায়। তাই আকাশ নীল দেখা যায়। আমরা সূর্যের ছড়িয়ে পড়া এই আলোকে আকাশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে দেখি, যা আকাশকে রঙিন করে তোলে।
আমাদের মস্তিষ্ক রংকে ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকভাবে। কোনো দৃশ্য দেখার সময় আমরা এক বস্তুকে অন্যগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখি।
কিন্তু নীলের চেয়ে বেগুনি আলোর ছড়িয়ে পড়ার গুণ বেশি। তবুও আকাশকে বেগুনি দেখা যায় না কেন? তার কারণ সূর্য যতটা নীল আলো নিঃসরণ করে, ততটা বেগুনি আলো করে না। সূর্য থেকে বেগুনি আলো তুলনামূলক কম নিঃসৃত হয়। আবার আমাদের চোখও বেগুনির প্রতি অতটা সংবেদনশীল নয়। তাই আকাশ বেগুনি দেখায় না।
আবার সূর্যের আলোতে নীলের চেয়েও বেশি থাকে সবুজ রং। তবু আকাশকে ঘাসের মতো সবুজময় হতে দেখি না কেন? তার কারণও প্রায় একই। মানে সবুজের চেয়ে নীল আলো বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি লালের চেয়েও বেশি ছড়ায় নীল। এই রংটা যদি সূর্যের আলো থেকে হটিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে আকাশ দেখাতো হিমু রঙের। মানে হলদে।
তাছাড়া আমাদের মস্তিষ্ক রংকে ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকভাবে। কোনো দৃশ্য দেখার সময় আমরা এক বস্তুকে অন্যগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখি। তাই আকাশ যদি নীল দেখায়, তাহলে সূর্যকে কিছুটা হলুদ দেখাতে পারে। কিন্তু সূর্যের রং অনেকেই হলুদ বলে দাবি করলেও তা সত্যি নয়। তাই যদি হতো, তাহলে সূর্যের আলোতে একটা সাদা কাগজকে দেখাত হলদে। কারণ সাদা কাগজ সব আলোই ভালোমতো প্রতিফলিত করতে পারে। তাই সাদা কাগজ থেকে হলুদ রংই প্রতিফলিত হতো। কিন্তু সেটা আসলে সাদাই দেখায়।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় সূর্যকে হলুদ বা লাল দেখায় কেন? আসলে দিগন্তের কাছে সূর্য থাকলে তার আলোকে আমাদের চোখে পৌঁছাতে বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে অনেক বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। এ সময়ও নীল আলোই বেশি বিক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু এখানে পথ পাড়ির দেওয়ার ক্ষেত্রে আসলে দৌড়ে জিতে যায় দীর্ঘ তরঙ্গের আলো। অর্থাৎ লাল বা হলদে আলো। তাই আমাদের চোখে লাল আলোটা পৌঁছাতে পারে। তাই এ সময় সূর্য বা আকাশ কিছুটা লালচে দেখায়।
সূর্য থেকে কোন রঙের আলো বেশি নিঃসৃত হয়?
এবার বলুন তো, সূর্য থেকে কোনো আলো বা রশ্মি সবচেয়ে বেশি নিঃসৃত হয়? অবলোহিত? গামারশ্মি? নাকি অন্য কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো? এর উত্তরে বেশিরভাগ মানুষই ভুল উত্তর দেবেন নিশ্চিত। এবারও কেউ বলবেন, হলুদ আলো। কেউ বলবেন, লাল আলো। কেউ কেউ সাদা আলোর কথাও বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত উত্তর হলো, সবুজ আলো। সূর্য থেকে এটাই সর্বোচ্চ পরিমাণে নিঃসৃত হয়। এই রঙের আলোই সবচেয়ে উজ্জ্বল। এরপরেই অবস্থান নীলের। আর লাল অংশটা কিছুটা ফিকে। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮০ থেকে ৭৮০ ন্যানোমিটার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কাকতালীয় মনে হতে পারে, সবুজের অবস্থান আলোর বর্ণালী একদম মাঝখানে। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ন্যানোমিটার। অর্থাৎ সবুজের একপাশে রয়েছে বেগুনি, নীল ও আসমানী এবং অন্যপাশে রয়েছে হলুদ, কমলা ও লাল।
কথাটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই তো! ভাবছেন, কথাটা সত্যি হলে তো সূর্যকে সবুজ দেখার কথা। তা দেখি না কেন? তার উত্তর দেওয়ার আগে বলি, সূর্য থেকে সবুজ আলো বেশি নিঃসৃত হয় বলেই রংধনুতে সবুজের এত ছড়াছড়ি। রংধনুতেও সবুজ রংটাই সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখায়। সূর্যের আলোতে একটা প্রিজম ব্যবহার করে এ কথার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে কেউ। প্রায় চারশ বছর আগে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো চালনা করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন, সূর্যের আলো রংধনুর মতো সাতটি আলাদা রঙে বিশ্লিষ্ট হয়ে যাবে। একটা প্রিজম যোগাড় করতে পারলে, পরীক্ষাটা নিজেও হাত-কলমে করে দেখতে পারবেন। তাহলে দেখা যাবে, সেসব রঙের মধ্যে সবুজই জ্বলজ্বল করবে সবচেয়ে বেশি।
তাহলে জরুরি প্রশ্নটা হলো, সূর্যকে সবুজ দেখায় না কেন? এর সরল উত্তর আগেও আলোচিত হয়েছে। কারণ আমাদের চোখ এমনভাবে ডিজাইন করা, যাতে সূর্যের মৌলিক রং—অর্থাৎ সবুজ, লাল ও নীল—একসাথে রেটিনায় আঘাত করলে, পুরো মিশ্রণটি সাদা হিসেবে ধরা পড়ে। সাদা মানে এতে সব রংই আছে।
এ কথা মাথায় রেখে সবুজ ঘাস বা গাছের সবুজ পাতা দেখে অনেকে ভুল ভেবে বসতে পারেন (পাতার উপাদান ক্লোরোফিল নামের সবুজ এক যৌগ)। অনেকে হয়তো যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে সিদ্ধান্ত পৌঁছাবেন যে উদ্ভিদজগৎ সূর্যের সবুজ রংটাই বেশি পছন্দ করে। তাই তাদের রং এমন সবুজে সবুজময়। কিন্তু পাতা, গাছপালা বা ঘাস মোটেও সবুজ রং পছন্দ করে না। বরং সূর্যের নীল ও লাল তরঙ্গদৈর্ঘ্যটাই তাদের বেশি পছন্দের। এই দুই আলো শোষণ করেই সম্পন্ন করে খাদ্য উৎপাদনের জন্য সালোকসংশ্লেষণের মতো জটিল প্রক্রিয়া। বিপরীতে সূর্যালোকের সবুজ অংশটা প্রতিফলিত করে। তাই ঘাসে ছাওয়া মাঠটাকে আমরা সবুজ দেখি। তখন আমাদের মনে হয়, ‘পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;’ (জীবনানন্দ দাশ)।
শহরের কৃত্রিম আলো থেকে অনেক দূরের কোনো গ্রামে পূর্ণিমা দেখার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। পূর্ণ চাঁদের এই জোছনায় পৃথিবীকে দেখা যায় সবজে-নীল বা ফিরোজা রঙের।
আসলে কোনো বস্তু আলোর যে অংশটা বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যটা শোষণ করে, সেটা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু যে অংশটা প্রতিফলিত করে, সেটা দেখতে পাই। যেমন কালো রঙের বস্তু আসলে সব রং শোষণ করে, তাই সেটা কালো। সাদা বস্তু তার ওপর পড়া সব রং প্রতিফলিত করে, তাই সেটা চোখে সাদা হয়ে ধরা পড়ে। একইভাবে কোনো বস্তু লাল হওয়ার অর্থ, বস্তুটা সব রং শোষণ করলেও একমাত্র লাল রংটাই প্রতিফলিত করছে। একইভাবে ঘাস বা গাছের কাছে সূর্যের আলোর যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যটা বা অংশটা অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয় সেটাই আমাদের চোখে ধরা পড়ছে সবুজ হয়ে।
যাই হোক, সূর্যের এই বিশেষ গুণের কারণে আমাদের মধ্যে এক ধরনের পক্ষপাত আছে। একে বলা চলে সূর্যের প্রতি পক্ষপাত বা সান বায়াস। রাতের আকাশে তাকালে গ্রহগুলো দেখে স্বস্তি। রাতের তারাভরা আকাশে তাকিয়ে পার্থিব মুগ্ধতায় ভরে ওঠে মন। জুড়ায় চোখও। আকাশের সব নক্ষত্রই প্রায় একই ধরনের আলো নিঃসরণ করে। সেগুলোও আমাদের সূর্যের মতো একই রঙের সমন্বয়ে গঠিত। কাজেই বলাই যায়, আমরা সূর্যের চোখে মহাবিশ্ব দেখি। কারণ আমাদের রেটিনা ও মস্তিষ্কে সূর্য-চশমা আটা।
সূর্যের শক্তির সর্বোচ্চ অংশ সবুজ আলো হওয়ার কারণে এ রংটা আমরা সবচেয়ে সহজে অনুভব করতে পারি। গোধূলি বেলায়, আলো যখন ঘোলাটে হয়ে যায়, রংগুলো প্রায় বিবর্ণ হয়ে যায়, তখনও ঘাস বা গাছের পাতা সবুজ দেখতে পাই। কিন্তু লাল জামা ও বেগুনি ফুলগুলো আমাদের চোখে ধুসর লাগে। রাতের বেলা আমরা যে বেশিরভাগ বস্তুর প্রকৃত রং বুঝতে পারি না, এটাই তারই প্রথম ধাপ। একে সাময়িক বর্ণান্ধত্ব বলা যায়।
শহরের কৃত্রিম আলো থেকে অনেক দূরের কোনো গ্রামে পূর্ণিমা দেখার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। পূর্ণ চাঁদের এই জোছনায় পৃথিবীকে দেখা যায় সবজে-নীল বা ফিরোজা রঙের। প্রশ্ন হলো, সাদা চাঁদের আলোয় সবকিছু এমন ফিরোজা রঙের হয়ে ওঠে কেন?
সে উত্তর দেওয়ার আগে আরেকটা কথা বলে নিই। আলোকচিত্রী, চিত্রশিল্পী ও সিনেমা নির্মাতারা চাঁদের আলোর এই অদ্ভুত প্রভাব সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। তাই সিনেমা বা নাটকে রাতের দৃশ্য ধারণ করতে এই জ্ঞানটুকু কাজে লাগান। চাঁদের পৃষ্ঠ আসলে সূক্ষ্ণ গুড়ো ধুলিবালি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবু সেখান থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়। অনেকটা আয়নার মতো। তবে সে আয়না চকচকে নয়, ঝাপসা। তাই ঠিকমতো আলো প্রতিফলিত করতে পারে না। চাঁদের উজ্জ্বলতা সূর্যের উজ্জ্বলতার চেয়ে প্রায় সাড়ে চার লাখ ভাগ কম। সিনেমার ফটোগ্রাফাররা তাই প্রায়ই সূর্যের আলোতে কোনো দৃশ্যের শুটিং করেন। এরপর উষ্ণ রংগুলো ব্লক করতে ফিল্টার ব্যবহার করেন। আলো আরও কমাতে বা আরও অনুজ্জ্বল করতে লেন্সের ফোকাল লেন্থেও কারসাজি করেন। ব্যস, কেল্লা ফতে! এভাবেই তৈরি হয় চাঁদের আলোর জোছনার বিভ্রম। কিন্তু চাঁদের আলোর আসল রং ফিরোজা কেন?
আগেই বলেছি, চোখের রেটিনায় দুই ধরনের কোষ থাকে—রড ও কোন কোষ। দিনের আলোতে কোন কোষ সক্রিয় থাকায় সব রঙের আলো অনুভব করা যায়। বিশেষ করে হলদে-সবুজের প্রতি রেটিনার সংবেদনশীলতা থাকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কম আলোতে অনুভব বদলে যায় নীলচে আলোতে। রেটিনার সংবেদনশীলতা বেড়ে যায় নীলচে-সবুজের প্রতি। আর আলোর বর্ণালী রেখার অন্য প্রান্তের লাল ও বেগুনির প্রতি সংবেদনশীলতা হুট করে নাই হয়ে যায়। এ রংগুলো তখন চোখে ধরা পড়ে ধুসর রঙে। তাই চাঁদের আলো দেখতে ওমন ফিরোজা লাগে।
কম আলোতে চোখের সংবেদনশীলতার এই পরিবর্তনকে বলা হয় পারকিনজে শিফট। পোলিশ বিজ্ঞানী জ্যান পারকিনজে প্রথম ব্যাপারটা খেয়াল করেন। তাই তাঁর নামেই এর নামকরণ করা হয়। অপরাধ তদন্তে যে হাতের ছাপ ব্যবহার করা যায় সে কথাও প্রথম বলেন তিনি। যাই হোক, রেটিনার কোণ আকৃতির কোন কোষগুলো কাজ করে কালার রিসেপ্টর হিসেবে। দিনের আলো যথেষ্ট ম্লান হয়ে গেলে আমরা প্রকৃতির সবুজ রং অনুভব করতে পারলেও কমলা ও লাল অনুভব করতে পারি না। এ কারণে আধুনিক শহরগুলোতে এখন ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর গাড়িগুলো রাঙানো হয় লাল রঙে নয়, সবুজ রঙে। কারণ রাতের বেলা প্রচলিত লার রঙ আমরা ভালো করে বুঝতে পারি না। একই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের হাইওয়ের সাইনগুলোর জন্যেও এখন বেছে নেওয়া হচ্ছে সবুজ রং।
সূর্যের আলো ও রঙের এই অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারের আসলে শেষ নেই। সেগুলো বলা যাবে আরেকদিন।
0 Comments